বর্ষার পর শুভ্রতা নিয়ে প্রকৃতিতে আসে শরৎ। বসন্তের মতো রূপের জৌলুস না থাকলেও শরতের আছে আকাশজুড়ে সাদা মেঘের বাহার। সেইসঙ্গে নদীর রুপালি সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে চোখ জুড়ানো কাশবন। হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় কাশফুল। ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুরই রয়েছে আলাদা পরিচয়। সেই পার্থক্য অনেকটাই ফুটে ওঠে ফুলে ফুলে। শরতে ফুলবতী হয় ছাতিম, কুল ও কাশ, গন্ধভাদালি, পান্থপাদপ, শিউলি, আকাশিয়া ইত্যাদি। শরৎ ঋতুকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর—এসব মিলিয়েই শরৎ। এর স্নিগ্ধতা এককথায় মনভোলায় যে কারও। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন ও নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই অনেক মধুর। শরতের সৌন্দর্য তুলে ধরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।’ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশে শরতের আগমনী বার্তা ইট-পাথরের নগরে বোঝার উপায় কম থাকে। আর বোঝা গেলেও নগরজীবনের ব্যস্ততায় তেমন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে না। তবুও কিছু আয়োজন নগরবাসীকে এখনো জানান দিয়ে যায়—ঋতুচক্রের আবর্তে প্রকৃতিতে এসেছে শরৎ। স্নিগ্ধ এ ঋতু উপভোগের চেষ্টা করেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যার প্রমাণ মেলে। হাস্যোজ্জ্বল মুখের দুপাশে কাশফুলের ডাঁটা। বাতাসে দোল খাচ্ছে কাশফুল। পরনে নীল শাড়ি, সাদা ব্লাউজ কিংবা নীল-সাদার মিশেলে অন্য কোনো পোশাক। এর সঙ্গে অবশ্যই টিপ। মেয়েরা সাধারণত এভাবেই সাজে শরতে। ছেলেদের পরনে থাকে নীল পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। যেমন করে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। তেমনি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় পাতায় এমন ছবি দেখা যাবে আর কিছুদিন পরই। শরতের স্নিগ্ধতা উপভোগের পাশাপাশি নিজের মধ্যেও তা ধরে রাখতে আরামদায়ক পোশাক পরাই ভালো। আর সব মৌসুমে দেশনন্দিত ফ্যাশন হাউস ‘রঙ বাংলাদেশ’ বিশেষ আয়োজন করার চেষ্টা করে থাকে। তাই এখন ‘রঙ বাংলাদেশে’র সব আউটলেটেই শরতের রঙেঢঙে এসেছে নানান ফ্যাশন অনুষঙ্গ। এজন্য এ সময়ে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘রঙ বাংলাদেশ’ নিয়ে এলো শরতের বিশেষ আয়োজন। পোশাকের নকশায় উঠে আসে শরৎ শুভ্র আকাশের রং, প্রকৃতি অনুসৃত সুন্দর নীল-সাদা সংমিশ্রণ। সঙ্গে আরও আছে সাদা, নানা শেডের নীল, আকাশি, নীলাভ ধূসর রং। এ শরতে মেয়েদের জন্য আছে আকাশি ও সাদা বর্ণের শাড়ি এবং সঙ্গে পছন্দ অনুসারে ব্লাউজ ও গহনাও আছে প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে। ছেলেদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পাঞ্জাবি। এ ছাড়া পাবেন সালোয়ার কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ, গাউন, আনস্টিচ ড্রেস, স্কার্ট, ওড়না, পায়জামা, টি-শার্ট, শার্ট, ফতুয়া, কাতুয়া, একসেসরিজসহ আরও অনেক সামগ্রী। গরমের প্রকোপ থাকায় কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণত নানান ধরনের সুতি। আর্দ্রতার কথা মাথায় রেখে পোশাকের প্যাটার্নও হয়েছে ঢিলাঢালা, ক্যাজুয়াল। বাংলাদেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ড রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস বলছিলেন, আমরা সবসময় চেষ্টা করি বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে সজীব রাখতে। সে উদ্দেশ্যেই বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের অনন্য কাল—শরতের অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরার প্রচেষ্টা আমাদের এবারের আয়োজনে। এ আয়োজনে শরতের উপযোগী সুতি, লিনেন, হাফসিল্ক, মসলিন, পেপার সিল্ক ইত্যাদি আরামদায়ক কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে। পোশাকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রকৃতির আলোকে নীল, আকাশি ও সাদা রঙের কম্বিনেশন। পণ্যের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য পোশাকের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে স্ক্রিন প্রিন্ট, ব্লক প্রিন্টসহ নানারকম হাতের কারুকাজ। তৈরি করা হয়েছে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ, ফ্রক, পাঞ্জাবিসহ রকমারি কালেকশন। থাকছে পুরো পরিবারের জন্য ম্যাচিং পোশাকও। ভার্চুয়াল জগতের বাইরে আশপাশে একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে শরতের আগমনী বার্তা। রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি ও বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে কাশবন চোখে পড়ে। এ ছাড়া বালু-মাটি দিয়ে ভরাট কোনো আবাসন প্রকল্প কিংবা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার চরসহ অনেক জায়গায় এখন কাশবনের ল্যান্ডস্কেপ। ঢাকার বহুতল ভবনের ছাদেও উঁকি দেয় কাশফুল। অনেকেই ছাদবাগানের টবে সাজিয়ে রাখেন কাশফুল। অনেক উঁচুতে সেগুলো ছড়ায় শুভ্রতা। নগর জীবনে শরৎ এখন এভাবেই উদযাপিত হয় বাঙালির দিনযাপনে। প্রকৃতিতে শরৎ হাজির হলেও নগরজীবনে এর স্নিগ্ধতার পরশ খুব একটা মেলে না। ব্যস্ত নগরে শত ব্যস্ততার মধ্যে মনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী শরতের রং উপভোগের সুযোগ পাওয়া দুষ্কর। তবু মন হারাতে চায় শরতের কাশফুল, গোধূলি, শিউলি আর জ্যোৎস্নার মধ্যে। সেজন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন শরৎ উৎসবের আয়োজন করে থাকে নগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছায়ানট, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন উৎসব সাজায় গান-কবিতা-নাচসহ নানান আয়োজনে। শরৎকালে আছে এক বড় পার্বণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব, দুর্গাপূজা। শরৎকালে পূজা, তাই এর নাম শারদীয় দুর্গাপূজা। ঢাকে কাঠি পড়তেই আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে শরৎ। শরৎ উদযাপনে এ উৎসব যোগ করে আনন্দের বাড়তি মাত্রা। যেহেতু উৎসব, ফ্যাশন বাজারেও তার প্রভাব পড়ে। বেড়ে যায় কেনাকাটা। তবে তাতে শুধু শরতের প্রকৃতির রং-ই থাকে না; বরং উৎসবের রংগুলোর প্রাধান্যও চোখে পড়ে। শরতের মনভোলানো প্রকৃতি ভালোভাবে উপভোগ করা যায় গ্রামে। নদীপাড়ে ভেসে বেড়ায় শিশিরভেজা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। আর থাকে সাদা কাশবনের ঢেউ খেলানো নাচ। মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলায় মন হয়ে যায় উদাস, আবার কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রোজ্জ্বল। শরতের প্রকৃতি যেন দূর গ্রামের দিগন্তরেখার নিচে ঘনায়মান সন্ধ্যার মতোই শান্ত ও মধুর। এমন একটি ঋতু শুধু ভাবনায় নয়, বাস্তবেও নির্মাণ করা সম্ভব। যদিও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে শরতের সেই রূপ-মাধুর্য এখন আর আগের মতো নেই। তবুও ঋতুচক্রে শরৎ আসে। আর এই ঋতুচক্রের বর্ণিল দোলায় উদ্ভাসিত হোক স্নিগ্ধ শরতের শুভ্র কাশফুল।
