মেঘের ভেলায় শরতের সাজ…

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শরৎ মানেই একদিকে আকাশে ভাসছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আরেক দিকে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে শিউলি। প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে বিমোহিত করার জন্য শরতের আগমন। শরৎ শুধু ঋতুর নাম নয়। এটি ফেলে রাখা জামা-শাড়ির গুমোট গন্ধ ঝরানোর গান, সাজের সরলতার নাম আর নারীর স্নিগ্ধ সাজে চিকন চুড়ির মৃদু ঝংকার। সাদা-নীলের মিশেলে, শিউলির গন্ধে, নদীতে বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের ছন্দে শরৎ শেখায় সহজ হয়ে বাঁচতে।

মেঘের সঙ্গে পোশাকের যোগ
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা…। যে-ই ভাসাক না কেন মেঘ ভাসছে এটিই সত্যি। বর্ষার ঝরঝর মুখর বৃষ্টিকে হটিয়ে শরতের আগমন ঘটে ঠিকই কিন্তু এত সহজে তো বাদলা দিনের জোর থেমে যাওয়ার নয়। মাঝেমধ্যেই একপশলা বৃষ্টির দেখা দিয়েই কালো মেঘ উধাও। আবার দেখা যায় রোদের ঝলক।  তবে রোদ-মেঘের লুকোচুরিতে শরৎ হয়ে ওঠে ভীষণ আরাধ্য। এসব দেখার জন্য মনের এক কোণে শরতের জন্য অজান্তেই অপেক্ষা করেন অনেকে।

শরৎ মানুষের মনে আনে উৎসবের ছোঁয়া। পাশাপাশি শরৎ যেহেতু সঙ্গ চায় তাই সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরে-বেড়িয়ে নিজেকে প্রাণোচ্ছল করার একটি বার্তাও থাকে শরতের দিনগুলোয়। বাংলায় শরতের সঙ্গে শিউলির যোগ চিরকালীন। ভাদ্র-আশ্বিন এই দুটো মাস উঠানের কোণে দেখা মেলে সুগন্ধি শিউলির। শহুরে আবহে খুব আবেগে শিউলি কুড়ানোর সুযোগ খুব বেশি মেলে না আমাদের। তাই জামাকাপড়ে এর মোটিফই হয়ে ওঠে আমাদের আবেগের স্মারক। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস শরতের মোটিফ নিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছে। সেসব পোশাকে শরৎ উঠে এসেছে শাড়ির আঁচল, পাড় কিংবা জমিনে। আর রং হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে সাদা আর নীল। এ ঋতুর স্মারক শিউলি, পদ্ম, শাপলা-শালুক, কাশফুল, নদী, নৌকা, পাখি ইত্যাদি উঠে এসেছে মোটিফে। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি, পাঞ্জাবিসহ সব ধরনের পোশাকে উঠে এসেছে শরতের প্রকৃতি। বায়ু চলাচলকে প্রাধান্য দিয়ে সুতিপ্রধান পোশাকে নকশায় থাকছে সুঁই-সুতার কাজ, হ্যান্ডপেইন্ট, স্ক্রিনপেইন্ট ও ব্রাশপেইন্ট, কাঠ ব্লক ও বাটিক। আছে মেশিন এমব্রয়ডারি, এমনকি ডিজিটাল প্রিন্টও।

এ বিষয়ে কথা হয় রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, শরৎকাল প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্যের ঋতু। সাদা মেঘ, নীল আকাশ আর কাশফুলের স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে চারদিক। শরতের সাজের মূল দর্শন হলো প্রাকৃতিক আবহকে ধারণ করা। এই ঋতুর আবহে সাজ ও পোশাকে থাকা চাই সরলতার ছোঁয়া। তাই সাজসজ্জা যেন হয় হালকা, আরামদায়ক এবং সহজাত, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও নিজস্ব রুচি মিলেমিশে এক স্নিগ্ধ উপস্থাপন তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, শরতে মেয়েদের জন্য আকাশি, সাদা বা হালকা নীল রঙের শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ হতে পারে উপযুক্ত। কটনের মতো আরামদায়ক কাপড় শরতের উষ্ণতা কমাতে সাহায্য করে। সাজে ভারী অলঙ্কার নয়, বরং রুপালি চুড়ি, হালকা গহনা আর কানে তাজা ফুল হতে পারে অনন্য সংযোজন। আর ছেলেদের জন্য সাদা বা যেকোনো অফরঙের পাঞ্জাবি, সঙ্গে সাদামাটা পায়জামা বা পাঞ্জাবি-প্যান্ট মানিয়ে যায় দারুণভাবে। পোশাকের সঙ্গে স্যান্ডেল বা নাগরাই হবে স্বাভাবিক অথচ স্টাইলিশ নির্বাচন।

সাজ আর গহনায় শরতের ছোঁয়া
শরতের প্রথমদিকে ভ্যাপসা গরমে মানুষ খুবই ঘামে। সারা দিনের কাজ শেষে কীভাবে সতেজ ও ঝরঝরে থাকা যায় সেদিকে রাখতে হয় বাড়তি খেয়াল। এ বিষয়ে রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা হাসান বলেন, ‘শরতে ক্রিম ব্যবহার না করে জেল-বেজড ময়েশ্চারাইজার বা সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ত্বকের জন্য ভালো। এতে চিটচিটে ভাব অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’ এদিকে মেকআপ করার আগে মুখ ভালোভাবে ক্লিনজার দিয়ে ধুয়ে একটুকরো বরফ ঘষে নেওয়া যেতে পারে। এরপর ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন লাগিয়ে তারপর মেকআপ করতে হবে।

আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরতের মেকআপ হবে হালকা। এই আবহাওয়ায় গাঢ় রং কিংবা ভারী মেকআপ একেবারেই বেমানান। ম্যাট বা ক্রিমি লিপস্টিক এবং হালকা রঙের শেড ব্যবহার করা ভালো। আবার ব্লাসনের ক্ষেত্রেও হালকা শেড ভালো দেখায়।

ঘামে কাজল লেপ্টে যাওয়ার সমস্যায় ভোগে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। সে জন্য কাজল ও আইলাইনার হতে হবে ওয়াটারপ্রুফ। এতে সতেজ ও ঝরঝরে লাগবে সারা দিন। চোখের পাতায় পাউডার ব্যবহার করলে মেকআপ ভালোভাবে সেট হয়। এ সময় ভারী গহনা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। লম্বা মালা, কানে টপ, হাতে ছোট আংটি, চিকন চুড়িই সাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ট। শাড়ি বা টপ যাই পরুন না কেন গহনা আর সাজের ক্ষেত্রে স্নিগ্ধতার প্রাধান্য দিতেই হবে।

খেয়াল রাখুন নিজের
আলমিরায় চোখ বুলান। তুলে রাখা কাপড় উল্টেপাল্টে শুকিয়ে নিন। এতে কাপড় ভালো থাকবে
ব্যাগে টিস্যু পেপার, ফেসিয়াল ওয়াইপ, সানস্ক্রিন পাউডার, ছাতা ও পানির বোতল রাখতে ভুলবেন না
বেশি বেশি পানি খান, শরীর হাইড্রেটেড রাখুন
ক্রিম ব্যবহার না করে জেল-বেজড ময়েশ্চারাইজার কিংবা সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন
পাউডার অথবা জেল-বেজড মেকআপ ব্যবহার করুন
পরনের ক্ষেত্রে হালকা নকশার জামা বেছে নিন
জুতো বা স্যান্ডেলের ক্ষেত্রে বায়ু চলাচল ভালো হয় এবং সহজে শুকায় এমন কিছু বেছে নিন

বলে রাখা ভালো, বাকি প্রতিটি ঋতুর মতোই শরতেরও খানিক মুডসুইং হয়। ফলে বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়াই ভালো। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া কাটে শরতের ছোঁয়ায়। ওয়ার্ডরোবে জমে থাকা জামা, আলমিরায় রাখা সারি সারি শাড়ির সবটা থেকেই গুমোট গন্ধ কাটাতে আসে শরৎ। আর শরতের বাতাস যেন মনের সব ক্লেদ ঝরিয়ে দেয়। ফলে রোদে আর বাতাসে প্রাণ চনমনে না হয়ে উপায় নেই।

শরতের শুভ্রতা পোশাকে বর্ষার শেষে সাদা সাদা টুকরো মেঘের সঙ্গে অনন্য সুন্দর নীলের আকাশে শরৎ ঋতু প্রকাশিত হয় স্বমহিমায়।

Leave a Reply

My Cart
Wishlist
Recently Viewed
Categories
Your Currency
$